ডাটা স্টোরেজের বিবর্তন

সিনিউজ ডেস্ক: কম্পিউটার প্রযুক্তির নানা দিক নিয়ে আমাদের প্রচুর চিন্তা থাকলেও স্টোরেজ ডিভাইস নিয়ে খুব বেশি চিন্তা কি করি? অথচ গত ছয় দশকে ডাটা স্টোরেজ ডিভাইসগুলো যেভাবে পরিবর্তিত হয়েছে সেটির কথা চিন্তা করলে প্রযুক্তির এই ক্ষেত্রটি সম্বন্ধে আমাদের চিন্তাধারা আমূল বদলে যাবে তাতে সন্দেহ নেই। আইডিসি-র তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে, এ বছর আমরা প্রায় ২.১৬ জেটাবাইট পরিমাণ ডাটা তৈরি করব। ২০১৬ সাল নাগাদ আমাদের তৈরি এসব ডাটার পরিমাণ দাঁড়াবে ৩.৭৭ জেটাবাইট। তবে আমরা ডাটা উৎপাদনে যতটাই দক্ষ হইনা কেন, ধরে নেয়া যায় যে ডাটা সংরক্ষণ করার ক্ষেত্রে আমাদের সামর্থ্যও একইসঙ্গে বাড়তে থাকবে।

মনে রাখতে হবে, ডাটা স্টোরেজ হচ্ছে সবচেয়ে দ্রæত বর্ধনশীল সেমিকন্ডাক্টর টেনোলজি। টেপ স্টোরেজ, হার্ড ডিস্ক স্টোরেজ আর সলিড স্টেট স্টোরেজ ডিভাইসের সংখ্যা প্রতি ১২ থেকে ১৮ মাসে দ্বিগুণ হয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে ডেস্কটপ ড্রাইভগুলোর ধারণক্ষমতা থাকে প্রায় ৪ টেরাবাইট। এ বছরের শেষে সেটি ৫ টেরাবাইটে পৌঁছাবে। এই পরিমাণ ধারণক্ষমতা ১০লক্ষ ছবি বা ৫৬২ ঘণ্টার এইচডি ভিডিও ধারণ করার জন্য যথেষ্ট। ২০২০ সাল নাগাদ সিগেট এমন হিট রেজিস্টেড ম্যাগনেটিক রেকর্ডিং প্রযুক্তি তৈরি করবে যেটির মাধ্যমে প্রায় ৬০ টেরাবাইট ধারণক্ষমতার ডেস্কটপ হার্ড ড্রাইভ তৈরি করা যাবে। এ পরিমাণ ক্ষমতার একটি ড্রাইভ ১ কোটি ২০ লাখ ছবি এবং প্রায় ৬৭৫০ ঘণ্টার এইচডি ভিডিও ধারণ করতে পারবে।

মাইক্রোএসডি কার্ড: ১২৮ এমবি থেকে ১২৮ জিবি
ন্যান্ড ফ্ল্যাশ মেমোরি, যেটি প্রায় ৬০ বছরের পুরোনো হার্ড ডিস্ক টেকনোলজির চেয়ে অনেক নবীন, সেটির ধারণক্ষমতা প্রতি বছর প্রায় ১৭৫ শতাংশ হারে বাড়ছে। এভাবে বাড়তে থাকলে এটি যে কোথায় গিয়ে শেষ করবে তা ভাবতেই আশ্চর্য লাগে। ১৯৮৭ সালে তোশিবা সর্বপ্রথম ন্যান্ড প্রযুক্তি উদ্ভাবন করে। ১৯৯৫ সালের এটি ক্যামেরার জন্য ৪০ মেগাবাইট মেমোরি কার্ড নিয়ে আসে। মাত্র ২০ বছরের মাথায় কী দেখতে পাচ্ছি? আজকের মাইক্রোএসডি ন্যান্ড মেমোরি কার্ড, যেটির আকার মানুষের হাতের আঙ্গুলের মাথার চেয়েও ছোট, সেটি প্রায় ১০০ বিলিয়ন বাইট ডাটা সংরক্ষণ করতে পারে। ১২৮ জিবির একটি ন্যান্ড ফ্ল্যাশ কার্ডে আপনি কতটুকু ডাটা স্টোর করতে পারেন? উত্তর হচ্ছে: প্রায় ৩২ হাজার গান, ২৭টি ডিভিডি মুভি এবং প্রায় আড়াই লক্ষ ছবি। স্ট্যান্ডার্ড প্ল্যানার ন্যান্ড ফ্ল্যাশ তার সর্বোচ্চ ধারণক্ষমতার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে বটে, তবে ত্রিমাত্রিক ন্যান্ড প্রযুুক্তি নিয়ে যে গবেষণা চলছে তা সফল হলে এর সামর্থ্য অদূর ভবিষ্যতে আরো অনেক বৃদ্ধি পাবে।

হার্ড ডিস্কের সামর্থ্য বেড়েছে ১০ লক্ষ গুণ!

বামে আইবিএম-এর জঅগঅঈ ৩৫০ আর ডানে আজকের বিপুল ধারণক্ষমতার হার্ড ড্রাইভ

১৯৫৬ সালে আইবিএম সর্বপ্রথম হার্ড ডিস্ক ড্রাইভ বাজারে নিয়ে আসে। এর নাম ছিল র‌্যাম্যাক ৩৫০ (জঅগঅঈ ৩৫০)। র‌্যাম্যাক কথাটির পূর্ণরূপ ছিল: র‌্যানডম অ্যাকসেস মেথড অব অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড কন্ট্রোল। এই র‌্যাম্যাক ৩৫০-র ভেতর ছির ২৪ ইঞ্চি আকারে ৫০টি ডিস্ক প্ল্যাটার এবং এর ওজন ছিল প্রায় ১ টন! অথচ এটি মাত্র ৫ মেগাবাইট পরিমাণ ডাটা সংরক্ষণ করতে পারত, অর্থাৎ মাত্র ১টি এমপিথ্রি মিউজিকের সমান। অথচ প্রতি মেগাবাইট ডাটা স্টোর করতে এর খরচ পড়ত আজকের হিসাবে প্রায় ৮০ হাজার টাকা! এবার এর সঙ্গে তুলনা করুন আজকের সাধারণ একটি ডেস্কটপ ড্রাইভের। এটি বর্তমানে ৪ টেরাবাইট পরিমাণ ডাটা সংরক্ষণ করতে পারে, এ বছরের শেষ নাগাদ এটি ৫ টেরাবাইট পরিমাণ ডাটা সংরক্ষণ করতে পারবে। এর মানে হচ্ছে, একটি মাত্র ড্রাইভে প্রায় সাড়ে ৭ লক্ষ এমপিথ্রি মিউজিক সংরক্ষণ করা যাবে। আর হিলিয়াম ভর্তি ডাটা সেন্টার ড্রাইভগুলো প্রায় ৬ টেরাবাইট পরিমাণ ডাটা স্টোর করতে পারবে? ভাবছেন এটাই অনেক? তাহলে শুনুন। ২০২০ সাল নাগাদ সিগেট হিট রেজিস্টেড ম্যাগনেটিক রেকর্ডিং (ঐঅগজ) নামে একটি প্রযুক্তি উদ্ভাবন করতে যাচ্ছে। এই প্রযুক্তির সাহায্যে এমন ডিস্ক তৈরি করা যাবে যা ৬০ টেরাবাইট পরিমাণ ডাটা স্টোর করতে পারবে। অর্থাৎ ঐ ডিস্কে ১ কোটি ৫০ লক্ষ গান এবং ৬৭৫০ ঘন্টার এইচডি ভিডিও স্টোর করা যাবে।
এন্টারপ্রাইজ ডিস্ক স্টোরেজ

কর্পোরেট ডাটা সংরক্ষণ করার জন্য সর্বপ্রথম যে ইএমসি সিমেট্রিক্স হার্ড ড্রাইভ স্টোরেজ অ্যারে তৈরি করা হয়েছিল সেটি আজকের একটি অতি সাধারণ পেন ড্রাইভের চেয়েও কম ডাটা ধারণ করতে পারত। ইএমসি সিমেট্রিক্স ১-এর ভেতর ডিস্ক ড্রাইভ ছিল ৪টি এবং এটির ধারণক্ষমতা ছিল মাত্র ২ গিগাবাইট। এবার চলে আসুন বর্তমানে। আজকের দশ প্রজন্মের ইএমসি সিমেট্রিক্স ভিএমএএক্স-এর একটি কেবিনেটে সাড়ে ৩ ইঞ্চি আকারের ২৪০টি ডিস্ক থাকে। সব মিলিয়ে এটির ধারণক্ষমতা হচ্ছে ২ পেটাবাইট। এর মানে হচ্ছে, মাত্র দুই দশক আগের প্রথম অ্যারেটির তুলনায় বর্তমানটির ধারণক্ষমতা বেড়েছে প্রায় ১০ লক্ষ গুণ। সাম্প্রতিকালে তৈরি স্টোরেজ অ্যারেতে আরো আছে ফ্ল্যাশ মেমোরি স্টোরেজ যেগুলো প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ২০ লক্ষ ইনপুট/আউটপুট অপারেশন সম্পন্ন করতে পারে।
ছোট হয়ে আসছে পৃথিবী …

আসলে পৃথিবী ছোট হচ্ছে না, তবে স্টোরেজ ডিভাইসের আকার আসলেই ছোট হয়ে যাচ্ছে। ১৯৭০ সালে তৈরি হয়েছিল ডাইসান-এর ডাইসান ডিস্ক প্যাক। এর ধারণক্ষমতা ছিল ২০০ মেগাবাইট অথবা ওজন ছিল ১০ পাউন্ড। এটিকে একটি আইবিএম ১৩১১ ডিস্ক ড্রাইভের মধ্যে ঢোকানো হত, যে ড্রাইভটির আকার ছিল ওয়াশিং মেশিনের সমান। এই ডিস্ক প্যাকটির প্ল্যাটারের আকার ছিল ১৪ ইঞ্চি যেগুলো সর্বপ্রথম ১৯৬৫ সালে তৈরি হয়। প্রতিটি ডিস্কে মোট ২০টি সেক্টর ছিল। প্রতিটি সেক্টরে ১০০টি করে কারেক্টার ধরত এবং এগুলো সেকেন্ডে ৫০ কিলোবাইট করে ডাটা ট্রান্সপার করত। এবার চলে আসুন আজকের দিনে। তোশিবার চঈওব ৫১২এই ন্যান্ড ফ্ল্যাশ ড্রাইভ-এর থ্রোপুট হচ্ছে ২জিবিপিএস। এই ড্রাইভটির এত বিপুল পরিমাণে সামর্থ্য অর্জন করেছে এর অতি ক্ষুদ্র ট্রানজিস্টরগুলোর বদৌলতে, যেগুলোর প্রতিটির আকার মাত্র ১৯ ন্যানোমিটার, মানে পদার্থের একটিমাত্র অণুর সমান!

আর এভাবেই স্টোরেজ প্রযুক্তিতে একের পর এক বিপ্লব নিয়ে আসার মাধ্যমে উপাত্ত ধারণের জগতে বৈপ্লবিক সব পরিবর্তন নিয়ে আসা হয়েছে। কাজেই প্রতি মুহূর্তে সৃষ্টি করে চলা ডাটার পাহাড় নিয়ে আমাদের আসলে চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই। বিজ্ঞানের আশীর্বাদে এগুলোকে ধারণ করার মত ডিভাইস আমরা সবসময় হাতের কাছে পাব এটা ধরে নেয়াই যায়।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।