এভাবেও পিতা মাতাকে সম্মান জানানো যায় – মোফাখখারুল ইসলাম

সিনিউজ ডেস্ক: বিদ্যাসাগরের সেই মাতৃভক্তির গল্পটা মনে আছে? এক ঝড়ের রাতে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর খবর পেলেন তাঁর মা অসুস্থ। সঙ্গে সঙ্গে পথে নেমে পড়লেন মাকে দেখতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। মাঝ পথে পড়ল উত্তাল দামোদর নদী। ঘাটে নেই খেয়া নৌকা। তবে কি ফিরে যাবেন বিদ্যাসাগর? দেখা করবেন না অসুস্থ মায়ের সঙ্গে? প্রশ্নই ওঠে না। বিদ্যাসাগর নেমে পড়লেন বর্ষায় ফুঁসতে থাকা দামোদরে। সাঁতরেই পার হলেন পুরো নদী। মায়ের সঙ্গে তাঁর যে দেখা করতেই হবে।
মাতৃভক্তির এমন গল্প আছে বায়েজীদ বোস্তামীকে নিয়েও। অসুস্থ মা পানি খেতে চেয়েছিলেন বায়েজীদ বোস্তামীর কাছে। ঘরে ছিল না পানি। বায়েজীদ পানি আনতে ঘর থেকে বের হলেন। ফিরে এসে দেখলেন, ঘুমিয়ে পড়েছেন মা। ঘুমন্ত মাকে আর ডাকলেন না বায়েজীদ। সারা রাত পানির গøাস হাতে দাঁড়িয়ে রইলেন মায়ের শিয়রের কাছে। ঘুম ভাঙলে মাকে পানি খাওয়াবেন!
সময়টা এখন বিদ্যাসাগর কিংবা বায়েজীদ বোস্তামীর নয়। সময় পেরিয়ে গেছে অনেক। সমাজে ঘটেছে নানা পালাবদল। তাই এইসব কিংবদন্তী গল্প ছাপিয়ে আরও নতুন নতুন গল্প তৈরি হচ্ছে আমাদের সমাজে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে যাচ্ছে মা বাবাকে সম্মান ও শ্রদ্ধা জানানোর পদ্ধতিও। যেমন মাকে সম্মান জানানোর এক অনন্য নজির সম্প্রতি স্থাপন করলেন ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান ড. মো. সবুর খান। তিনি তাঁর মায়ের নামে প্রতিষ্ঠিত ‘রওশন আরা স্কলার গার্ডেন’ নামের ছাত্রী হলটির উদ্বোধন করলেন মাকে দিয়েই।
রওশন আরা স্কলার গার্ডেন ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ছাত্রীদের জন্য নির্মিত ১০তলা বিশিষ্ট অত্যাধুনিক একটি হল। গত ২৪ অক্টোবর হলটির উদ্বোধন করেন ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য এবং ড. মো. সবুর খানের পরম শ্রদ্ধেয় জননী রওশন আরা বেগম। এমন নজির বর্তমান সময়ে নেই বললেই চলে। বর্তমান সময়টা বড় অস্থির। পত্রিকা খুললেই মূল্যবোধ ধ্বসে যাওয়ার নানা খবর। টেলিভিশন খুললেই নৈতিকতা হারিয়ে যাওয়ার খবর। সোশ্যাল মিডিয়ায় ঢুকলেই আদর্শহীনতার গল্পের ছড়াছড়ি। চারপাশে তাকালেই চোখে পড়ে পারিবারিক ভাঙন, বৃদ্ধ মা বাবাকে একা ফেলে রাখার গল্প, পিতামাতাকে নানাভাবে অশ্রদ্ধা জানানোর হিরিক। সেখানে ড. মো. সবুর খান সমাজের বুকে এক অনন্য দৃষ্টান্তই স্থাপন করলেন বলা যায়।
নিজের নামে হল উদ্বোধন করতে পেরে ভীষণ খুশি হয়েছেন ড. মো. সবুর খানের মাতা রওশন আরা বেগম। তিনি নিজেই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানিয়ে এনেছিলেন তাঁর অন্যান্য সন্তান, পরিবারের সদস্য ও নাতি-নাতনিদের। উদ্বোধনের পর হলের ছাত্রীদের সঙ্গেও হৃদ্যতাপূর্ণ সময় কাটান তিনি। এ থেকেই বোঝা যায়, তিনি কতটা খুশি হয়েছেন হল উদ্বোধন করতে পেরে। আমাদের মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা) অসংখ্যবার বলেছেন, পিতা মাতার সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারলে আল্লাহ সন্তুষ্ট হোন।
ড. মো. সবুর খান তাঁর পিতার নামেও হল নির্মাণ করেছেন যার নাম ‘ইউনুস খান স্কলার গার্ডেন’। হলটি ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ছাত্রদের আবাসনের জন্য নির্মিত। এই হলটি তিনি তাঁর বাবাকে দিয়ে উদ্বোধন করাতে পারেননি। এজন্য মনে আক্ষেপ রয়েছে ড. মো. সবুর খানের। তিনি বলেন, আব্বা মারা যান ২০১৪ সালে, তখনও ইউনুস খান স্কলার গার্ডেন পুরোপুরি নির্মিত হয়নি। মাত্র একতলা বা দুই তলা সম্পন্ন হয়েছে। আব্বা বেঁচে থাকলে হলটি তাঁকে দিয়েই উদ্বোধন করাতাম।
তখন ‘ইউনুস খান স্কলার গার্ডেন’ পুরোপুরি নির্মিত না হলেও নির্মিতব্য হল পরির্দশনে বেশ কয়েকবার এসেছিলেন ড. মো. সবুর খানের পিতা মো. ইউনুস খান। তিনি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে কাজ তদারকি করেছেন। অনেক সময় প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা দিয়েছেন। নির্মতব্য হল দেখে তিনি সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছিলেন। পিতার এই সন্তুষ্টি অর্জনই সন্তানদের জীবনের লক্ষ্য হওয়া উচিত।
আমরা প্রতিনিয়ত মা বাবাকে নানাভাবেই শ্রদ্ধা জানাই। তবু কখনো কখনো সুযোগ আসে একটু ভিন্নভাবে শ্রদ্ধা জানানোর। সন্তান যখন বিভিন্নভাবে সফল হোন তখন সন্তানের উচিত মা বাবাকে তার সাফল্যের অংশীদার করা। বিশেষ করে যেসব সন্তান উদ্যোক্তা হিসেবে সফল হোন, তারা যেন তাদের উদ্যোগের উদ্বোধনটা মা বাবাকে দিয়েই করেন। পিতা মাতাকে সম্মান জানানোর এর চেয়ে ভালো উপায় আর কিছু হতে পারে না বলে মনে করেন সফল উদ্যোক্তা ড. মো. সবুর খান। তিনি বলেন, পারিবারিক মূল্যবোধ আমাদের বেড়ে উঠতে সাহায্য করবে। কারণ শিকড় ছাড়া কোনো গাছ টিকতে পারে না। আর কে না জানে, পিতা মাতাই আমাদের শিকড়। আমাদের পিতামাতার প্রতি আমাদের সম্মান দেখানোর সময় এসেছে।
ড. মো. সবুর খানের এরকম বিভিন্ন ব্যতিক্রমী চিন্তার প্রতিফল দেখা যায় ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে। যেমন আর্ট অব লিভিং কোর্স, প্যারেন্টস ডে ইত্যাদি। এসব কারণে স্বকীয়তা লাভ করেছে ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।
ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির স্বকীয়তার মুকুটে যুক্ত হলো আরেকটি নতুন পালন। আর তা হচ্ছে উদ্বোধন সংস্কৃতিতে স্বকীয়তা। যে কোনো কিছু উদ্বোধন করতে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব থেকে শুরু করে সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিদেরকে আমন্ত্রণ জানানোই আমাদের দেশে রেওয়াজ। সেই রেওয়াজে পরিবর্তন আনলো ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।
ড. মো. সবুর খান বলেন, মন্ত্রী, তারকা ব্যক্তিদের মাধ্যমে উদ্বোধন করাটা দোষের কিছু নয়। আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন তাদের মাধ্যমে করা যেতেই পারে। তবে অনানুষ্ঠানিক উদ্বোধন কিংবা ভিত্তপ্রস্তর স্থাপন পিতা মাতার মাধ্যমে করা যেতে পারে। এর মাধ্যমে তাদেরকে সঠিক উপায়ে শ্রদ্ধাটা জানানো হয়। কারণ সন্তানের সাফল্যে সবচেয়ে খুশি হন পিতা মাতা। তাদেরকে সেই খুশির অংশীদার করা সন্তানের কর্তব্য। প্রতিটি সন্তানের মনে রাখা উচিত, তার সাফল্যের পেছনে লেগে আছে মা বাবার বিন্দু বিন্দু ঘাম। তাঁদের অমানুষিক ত্যাগ ও দিক নির্দেশনা ছাড়া কোনো সন্তান সফল হতে পারে না।
ড. মো. সবুর খান আরও বলেন, আমাদের সমাজ থেকে নৈতিকতা ও মূল্যবোধ ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। আমরা ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির মাধ্যমে চেষ্টা করছি সেসব মূল্যবোধ ফিরিয়ে আনতে। আমরা শুধু ছেলেমেয়েদেরকে একাডেমিক সার্টিফিকেটই দেই না, আমরা চেষ্টা করি তাদেরকে মানুষের মতো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে। সেজন্য ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ে আর্ট অব লিভিং কোর্স পড়ানো হয়, প্যারেন্টস ডে উদযাপন করা হয়। সম্প্রতি মাকে দিয়ে যে ছাত্রী হলের উদ্বোধন করা হলো, সেটিও ওই মূল্যবোধচর্চার অংশ। ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয় মনে করে, এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা মা বাবাকে শ্রদ্ধা ও সম্মান জানানো শিখবে।
ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির উদ্দেশ্য যে সফল তা বোঝা যায় প্রতিটি প্যারেন্টস ডে অনুষ্ঠানে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীরা তাদের মা বাবাকে নিয়ে আসেন। পানি দিয়ে নিজ হাতে মা বাবার পা ধুয়ে দেন।
পিতা মাতা যত বৃদ্ধই হোন না কেন, তাঁকে বিভিন্ন কাজের মধ্যে যুক্ত রাখা এবং সন্তানের জীবনে তাঁর প্রয়োজন যে ফুরিয়ে যায়নি, এই বোধ সৃষ্টি করাই একজন সন্তানের অন্যমত কর্তব্য। পিতা মাতা যেন কখনোই মনে না করেন, তাঁর প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে।
কথায় বলে, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপী গড়িয়সী। স্বর্গের চেয়েও গড়িয়সী যে জননী, তাঁকে সম্মান জানানোর কোনো সুযোগই হাতছাড়া করা উচিত নয় কোনো সন্তানের। ড্যাফোডিল চেয়ারম্যান সেই বার্তাই সম্ভবত দিতে চাইলেন সমাজের সফল মানুষদেরকে। আমরা কী সেই বার্তা অনুধাবন করতে সক্ষম? যদি সক্ষম হই, তাহলে আমাদের সমাজ আরও সুন্দর হয়ে উঠবে তাতে সন্দেহ নেই।

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।