ইন্টারনেটকে শক্তি জোগায় যে সমুদ্রতলবর্তী ক্যাবল

সিনিউজ ডেস্ক: ১৮৫৮ সালের জুলাই মাসের ২৯ তারিখ দুটি বাস্পীয় শক্তিচালিত যুদ্ধজাহাজ আটলান্টিক মহাসাগরের ঠিক মাঝখানে মিলিত হয়। সেখানে দুটো জাহাজ থেকে চার হাজার কিলোমিটার লম্বা ও দেড় সেন্টিমিটার পুরু দুটো তারকে পরস্পর জোড়া দেয়ার মাধ্যমে বিশ্বের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার মধ্যে টেলিগ্রাফ সংযোগ চালু করা হয়। এর ঠিক দুই সপ্তাহ পর বৃটেনের মহারাণী ভিক্টোরিয়া তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জেমস বুকানন-এর কাছে একটি অভিনন্দন বার্তা পাঠান। ইউরোপ-আমেরিকার এই ঐতিহাসিক টেলিগ্রাফ বন্ধনকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য এর ক’দিন পরই নিউ ইয়র্কের রাস্তায় একটি র‌্যালি আয়োজিত হয়। তারপর যেখানে ইউরোপ ও আমেরিকার মধ্যে বন্ধনসৃষ্টিকারী সেই জাহাজের একটি মডেল প্রদর্শিত হয় এবং সিটি হলের ওপর আতশবাজির প্রদর্শনীর আয়োজ করা হয়। সেই অভিনন্দন বার্তায় মহারাণী ভিক্টোরিয়া দুটি দেশের মধ্যে মহান আন্তর্জাতিক কর্মকাÐের ভূয়সী প্রশংসা করেন Ñ যা কিনা ছিল প্রায় দুই দশকের নিরলস প্রচেষ্টার ফসল। অন্যদিকে জেমস বুকানন এটিকে যুদ্ধের ময়দানে অর্জিত যেকোনো অর্জনের তুলনায় মানবজাতির জন্য মহত্তর একটি অর্জন বলে অভিহিত করেন। সেই বিখ্যাত বার্তাটি আটলান্টিক পার করতে মোর্স কোডে প্রতি অক্ষরের জন্য ২ মিনিট ৫ সেকেন্ড ধরে মোট ১৭ ঘণ্টা সময় লেগেছিল। আর সেই ক্যাবলও সাকুল্যে এক মাসেরও কম সময় কাজ করতে পেরেছিল, তারপরই সেটি বিকল হয়ে যায়। তবে তাতে কিছু আসে যায় না। কারণ ইউরোপ থেকে আমেরিকাকে সংযোগকারী সেই ক্যাবল এক বৈশ্বিক বিপ্লবের সুচনা করেছিল।

 

১৮৬৬ সাল নাগাদ সেই ক্যাবল প্রতি মিনিটে ৬ থেকে ৮টি শব্দ সম্প্রচারের ক্ষমতা অর্জন করে, শতাব্দী ঘুরতে না ঘুরতে সেটি মিনিটে ৪০ শব্দে পৌঁছে যায়। ১৯৫৬ সালে ট্রান্সআটলান্টিক নং-১ নামে বিশ্বের প্রথম সমুদ্রতলবর্তী টেলিফোন ক্যাবল স্থাপন করা হয় এবং ১৯৮৮ সাল নাগাদ এর ৮ম ভার্সনটি প্রতি সেকেন্ডে ২৮০ মেগাবাইটের সমপরিমাণ উপাত্ত সম্প্রচার করছিল, যেটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাসাবাড়িতে যে ইন্টারনেট সংযোগ দেয়া হয় সেটির তুলনায় গড়ে ১৫ গুণ বেশি। কারণ এই সংযোগ ছিল ফাইবার অপটিকের, যেটি অবিশ্বাস্য দ্রæতগতিতে উপাত্তকে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পৌঁছে দেয়ার জন্য ব্যবহার করে আলোকে। ২০১৮ সালে স্পেনের বিলবাও আর য২ুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়া অঙ্গরাজ্যের মধ্যে কাজ শুরু করে মারিয়া নামে একটি ক্যাবল। এটির উপাত্ত স্থানান্তর গতি ছিল প্রতি সেকেন্ডে ১৬০ টেরাবিট Ñ যা যুক্তরাষ্ট্রের বাসাবাড়িতে দেয়া গড় ইন্টারনেট সংযোগের তুলনায় প্রায় ১ কোটি ৬০ লাখ গুণ দ্রæতগতির। বর্তমানে সারা বিশ্বে ৩৮০টি সমুদ্রতলবর্তী ক্যাবল (ঁহফবৎংবধ পধনষবং) কাজ করছে যেগুলোর মোট দৈর্ঘ্য হচ্ছে ১২ লক্ষ কিলোমিটার বা প্রায় সাড়ে ৭ লাখ মাইল।

এসব আন্ডারসি ক্যাবলই হচ্ছে সেই অদৃশ্য শক্তি যা আজকের ইন্টারনেটকে পরিচালিত করছে। সাম্প্রতিক সময়ে যেসব আন্ডারসি ক্যাবল স্থাপিত হয়েছে তার অনেকগুলো স্থাপনের পয়সা জোগান দিয়েছে বড় বড় ইন্টারনেট কোম্পানি যেমন ফেসবুক, গুগল, মাইক্রোসফট ও অ্যামাজন। আজ আমরা যতরকম যোগাযোগ করছি তার প্রায় সবই এসব ক্যাবলই বহন করে নিয়ে যায়, অথচ আমরা বলতে গেলে কখনও এসব ভাবি না বা উপলব্ধি করি না। অথচ ইন্টারনেট আজ অনেক বেশি তারবিহীন ও মোবাইলভিত্তিক হয়ে পড়ার পরও আন্ডারসি ক্যাবল দিয়ে যে পরিমাণ ডাটা পরিবাহিত হয় তার পরিমাণ কিন্তু দিনদিনই বাড়ছে। এ বিষয়ে সীকম নামে একটি মাল্টিন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন প্রতিষ্ঠানের সিইও বায়রন ক্ল্যাটারবাক বলেন, ‘এখনও ইন্টারনেট যে পরিমাণে ক্যাবল-ভিত্তিক সেটি ভাবলে আশ্চর্য হয়ে যেতে হয়। মানুষ এখন অনেকটাই মোবাইল এবং সবসময়ই কেবল ওয়াই-ফাইয়ের খোঁজে থাকে, অথচ বিপুল পরিমাণে তারও যে তাদের ইন্টারনেট কর্মকাÐ সম্পন্ন করতে কাজ করে চলেছে সেটি তারা প্রায়ই টের পায় না। টের পায় কেবল তখন যখন ইন্টারনেট ক্যাবল কাটা পড়ে।’

 

২০১২ সালে হ্যারিকেন স্যান্ডির তান্ডবে যুক্তরাষ্ট্রের পূর্বপ্রান্তে আন্ডারসি ক্যাবল কাটা পড়ে প্রায় ৭১ বিলিয়ন ডলারের আর্থিক ক্ষতি এবং ইউরোপ ও আমেরিকার যোগাযোগ ব্যাপকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়েছিল। এছাড়াও বিভিন্নসময় ইন্টারনেটের ক্যাবল কাটা পড়ে। এর মধ্যে ভূমিকম্প এবং মানবসৃষ্ট নানা বিপর্যয়ও রয়েছে। ২০০৮ সালে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার কেজি ওজনের একটি নোঙ্গরের কারণে তার কাটা পড়ে উত্তর আফ্রিকা ও পারস্য উপসাগরীয় এলাকার অনেক জায়গা ইন্টারনেটবিহীন হয়ে পড়ে। আবার ইচ্ছাকৃতভাবে আন্ডারসি ক্যাবল কাটার ঘটনাও আছে। এদিকে পরাশক্তিগুলো কর্তৃক আন্ডারসি ক্যাবলে কান পেতে উপাত্ত চুরি ও আড়িপাতার ঘটনাও ঘটেছে। সব মিলিয়ে এসব ক্যাবলের নিরাপত্তা সবসময়ই হুমকির মধ্যে আছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া ও চীন Ñ এদের সবার বিরুদ্ধেই এই কাজের অভিযোগ আছে। সব মিলিয়ে বলা যায়, একুশ শতকের বিশ্বের সমুদ্রতলবর্তী ইন্টারনেট ক্যাবলের নিরাপত্তা আগের যেকেনো সময়ের চেয়ে বেশি হুমকির সম্মুখীন।

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।