ভার্টিক্যাল রেলস্টেশন যেভাবে বদলে দেবে ভবিষ্যতের ভ্রমণ

ট্রেনে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা কেমন তা জানেন? জানি, প্রশ্নটা শুনেই চমকে উঠবেন অনেকে। বিস্ময়ে ভ্রæ কুঁচকে যেতে পারে তাদের। আবার রাগও করে ফেলতে পারেন অনেকে। মনে মনে বলতে পারেন, এটা কী ধরনের বেয়াড়া প্রশ্ন হল? তবে রাগ করার আগে এ প্রশ্নটি করার কারণ জেনে নিন। আমি আসলে প্রশ্নের মধ্যে একটা শব্দ উহ্য রেখেছি, আর তা হল, ভবিষ্যৎ কথাটা। আমি বলতে চেয়েছিলাম, ভবিষ্যতের ট্রেনে ভ্রমণ কেমন সেটা কি জানেন? বলতে পারেন, কেমন আর হবে, এখন যেমন তেমনই। উত্তর যদি এটা হয়, তাহলে বলতেই হবে, আপনি ভুল করছেন। কারণ আমি এমন এক ভবিষ্যতের কথা বলছি যখন ট্রেন ভ্রমণের ব্যাপারটি আমূল বদলে যাবে। কারণ এখনকার মত সমান্তরাল দুই সারি রেল লাইনের ওপর ট্রেনের বড়িতে বসে চারপাশের দৃশ্যসুধা উপভোগ করতে করতে যাবেন না যাত্রীরা। তখন স্টেশনে েিগয় ট্রেনে ওঠার ব্যাপারটা হয়ে যাবে ভার্টিক্যাল, মানে মাটির ওপর আড়াআড়ি নয়, বরং বিশাল এক ভবনের উপর উঠে তারপর ট্রেনে উঠবেন এবং আপনি সহ সব যাত্রীকে নিয়ে ট্রেনটি ঠিক একটি সরীসৃপের মত বিশাল একটি ভবনের গা বেয়ে নেমে আসবে নিচে! শুনতে অবিশ্বাস্য মনে হলে এরকমই একটি পরিকল্পনা দাঁড় করানো হয়েছে বৃটেনে, যা আগামী দিনের ট্রেন ভ্রমণকে আগাগোড়া বদলে দেবার সংকল্প করেছে।

ভার্টিক্যাল রেলস্টেশনের গা বেয়ে নেমে আসছে ট্রেন

নতুন দিনের এই নতুন ট্রেন কনসেপ্টের নাম ভিির্টক্যাল হাইপার স্পিড ট্রেন। আর এই ট্রেন যে স্টেশন থেকে ছাড়বে তা একটি অত্যন্ত উঁচু টাওয়ার। বিশেষভাবে নির্মাণ করা এই আকাশচুম্বী অট্টালিকা থেকেই যাত্রীরা ট্রেনে উঠবেন, যে অট্টালিকার উচ্চতা হবে এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিংয়ের কাছাকাছি! ভবিষ্যতের জনবহুল মেট্রোপলিটন সিটিতে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে তাকবে এসব টাওয়ার তথা ভার্টিক্যাল হাইপার স্পিড ট্রেন হাব। এগুলোকে দেখাবে অনেকখানি জায়গা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা একটি রেলস্টেশনকে আড়াআড়িভাবে দাঁড় করিয়ে দিলে যেমন দেখাবে তেমন।

 

২০৭৫ সালে লন্ডন শহরে থাকবে এরকম আড়াআড়ি দাঁড়িয়ে থাকা রেলস্টেশন?

 

ক্রিস্টোফার ক্রিস্টোফালি এবং লুকাস মাজারাসা নামে দু’জন ডিজাইনারের মাথা থেকে বেরিয়েছে অসাধারণ এই স্টেশনের আইডিয়া। ভবিষ্যতের জনবহুল শহরে বহুমূল্য জায়গা সাশ্রয় করতেই এরকম স্টেশনের কল্পনা তাঁরা করেছেন বলে জানিয়েছেন দুই ডিজাইনার। এ ব্যাপারে ২৭ বছর বয়সী ক্রিস্টোফালি বলেন, ‘আগামী ৬০ বছর সময়ে বড় বড় শহরে রেলস্টেশন বানানোর মত বড় জায়গা খুঁজে পেতে খুবই বেগ পেতে হবে। সরকারগুলো তখন এ ধরনের নতুন ডিজাইনের মাধ্যমে শহরের মধ্যে রেলস্টেশন তৈরি করে স্থান সংকুলান করতে পারবে।’ দুজন ডিজাইনার প্রস্তাব করেছেন, সিলিন্ডারের আকারের বিশাল অট্টালিকাই হবে ভবিষ্যতের রেলস্টেশন।

যাত্রীরা দ্রæতগতির লিফট ব্যবহার করে সোঁ করে উঠে যাবেন অট্টালিকার ওপর, যার যার প্লাটফর্মে। তারপর তাঁরা উঠে পড়বেন ট্রেনের বগিতে। এক এক বগিতে মুখোমুখি দুটো সারিতে বসবেন ১০ জন করে যাত্রী। এরপর ভবনের গায়ে বসানো রেললাইন বা ট্র্যাক ধরে প্রচÐ বেগে ট্রেন নেমে আসবে মাটিতে। প্রশ্ন উঠতে পারে, ট্রেন যখন টিকটিকির মত দেয়াল বেয়ে খাড়াখাড়িভাবে নামবে তখন যাত্রীরা সিটে বসে থাকবেন কীভাবে? তাদেরতো উল্টে পড়ার কথা। উত্তর হল, এগুলো সাধারণ রেললাইনের ট্র্যাক হবে না, হবে চৌম্বক ট্র্যাক। প্রতিটি বগিকে ডিজাইন করা হয়েছে একটি ত্রিভুজের আকারে, যেটি দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় উলম্বভাবে থাকবে, আবার ট্রেন ভবনের গা বেয়ে নামতে শুরু করলে ঘুরে আনুভূমিক অবস্থায় চলে যাবে, ফলে ভেতরে বসে থাকা যাত্রীদের কোনো সমস্যা হবে না। ওয়াগনগুলো ফেরিস হুইলের মত ঘুরবে, ফলে সোজাসুজি, অর্থাৎ স্বাভাবিক অবস্থায় বসে থেকেই আশেপাশের নয়নাভিরাম দৃশ্য উপভোগ করতে যাত্রীদের কোনো সমস্যা হবে না।

ক্রিস্টোফার ক্রিস্টোফালি এবং লুকাস মাজারাসার এই ডিজাইন এ বছরের ভোলো স্কাইস্ক্র্যাপার প্রতিযোগিতায় বিশেষ পুরস্কার জিতে নিয়েছে। ডিজাইনারদের মতে, ভার্টিক্যাল রেলস্টেশনরূপী এই টাওয়ারের উপরে থাবে সবুজ প্লাজা, যেগুলোকে তৈরি করা হবে স্বতন্ত্র অবকাঠামো হিসেবে যা সারা বিশ্বের শহরগুলোতেই স্থাপন করা যাবে। তাঁরা আরো প্রস্তাব করেছেন ওভারগ্রাউন্ড রুট ও আন্ডারগ্রাউন্ড টানেলের একটি হাইপার স্পিড নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার, যেখানে সুপারফাস্ট ট্রেনগুলো মাত্র ৩০ মিনিটে ৩০০ মাইল পাড়ি দিতে পারবে। তাদের মতে, এর ফলে কেবল যাত্রীদের সময়ই বাঁচবে না, গণপরিবহন ব্যবস্থাকেই আমূল পাল্টে দেয়া যাবে। এছাড়া জীবাস্ম জ্বালানির বিকল্প হিসেবে বিদ্যুৎশক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে কার্বন নিঃসরণের হারকে কমিয়ে আনাও যাবে। এ ব্যাপারে ২৯ বছর বয়সী মাজারাসা বলেন, ‘আমাদের এই ডিজাইন তৈরি করা হয়েছে বর্তমানে যেসব প্রযুক্তি বিদ্যমান আছে সেগুলোর ওপর ভিত্তি করেই। যেমন, চীনে এ মুহূর্তে এরকম হাইপার স্পিড রেল নেটওয়ার্ক আছে যা প্রতি ঘণ্টায় ৩৬০ মাইল বেগে ভ্রমণ করতে পারে। ২০৭৫ সাল নাগাদ ট্রেনের এই গতিকে দ্বিগুণে উন্নীত করতে না পারার কোনো কারণ নেই। আর এভাবেই হাইপারস্পিড ট্রেনকে বিপুল সংখ্যক মানুষকে নিরাপদে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নিয়ে যাওয়ার বাহন হিসেবে আমরা ব্যবহার করতে পারি।’

বেশিরভাগ ভবিষ্যৎমুখী প্রকল্পের মতই এ প্রকল্পকেও বাস্তবতার অনেক সীমাবদ্ধতা ও বাধা অতিক্রম করতে হবে। দেশব্যাপী বিস্তৃত রেল নেটওয়ার্ককে কীভাবে এর মাধ্যমে সমন্বিতভাবে পরিচালনা করা যাবে তার অনেক খুঁটিনাটিই দুই ডিজাইনার এখনও চূড়ান্ত করেননি। তবে এ ব্যাপারে সন্দেহ নেই যে, ভবিষ্যতের জনবহুল শহরগুলোতে এ ধরনের ট্রেন ব্যবস্থা বাস্তবায়নের সমস্যার চেয়ে সম্ভাবনাই বেশি বলে মনে হচ্ছে।

সূত্র: সিএনএন।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।