২০১৪ সালের নভেম্বরে ঢাকার জাতীয় দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় একটি শীর্ষ সংবাদ পরিবেশন করা হয়, যাতে বলা হয় যে, আমাদের শিশুদের স্কুলব্যাগটা বড্ড ভারী। তারা জরিপ করে দেখিয়েছে যে, ১৫-২০ কেজি ওজনের শিশুকে ৬ থেকে ৮ কেজি ওজনের স্কুল ব্যাগ বহন করতে হয়। তারাই ডাক্তারদের পরামর্শ নিয়ে বলেছে যে, শিশুর মোট ওজনের শতকরা দশ ভাগের বেশি ওজনের ব্যাগ তার কাধে দেয়া উচিত নয়। এর ফলে শিশু শারিরীকভাবে ব্যাপক ক্ষতির শিকার হতে পারে। তারা নানা পরামর্শ দিয়ে বলেছে যে, শিশুর বই কমিয়ে, স্কুলে বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা করে-খাতার পরিমাণ কমিয়ে দিয়ে ব্যাগের ওজন কমানো যায়। প্রচলিত শিক্ষাদান পদ্ধতিতে এইসব চিন্তা ভাবনা নিয়ে সামনে আগানো যায়। কিন্তু কার্যত শিশুদের বইয়ের ওজন, খাতার ওজন বা পানির বোতল কোনটাই কমবেনা। বরং যদি ব্যাগটার ওজন আরও বাড়ে তবে তাতে আমাদের অবাক হবার কিছু থাকবেনা। ফলে ব্যাগের ওজন বাড়ার এই সমস্যার সমাধানও তাই পাঠক্রম কমানোতে বা বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করার পথেই হবে না।
আমি স্মরণ করতে পারি, নব্বই দশকেও আমার সম্পাদিত একটি পত্রিকায় শিশুদের ওজনদার স্কুল ব্যাগের প্রসঙ্গ আলোচনা করেছিলাম। প্রস্তাব করেছিলাম-শিশুদেরকে যেন তথাকথিত বিদ্যার ওজনে পিষ্ট না করা হয়। এসব কথা সরকারের শিক্ষানীতিতে আছে। সরকারিভাবেও পাঠক্রম পুনর্বিন্যাস করা হয়েছে। কিন্তু দিনে দিনে বই এবং বিষয়ের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। বৈষম্যটা কেমন তার একটি দৃষ্টান্ত উল্লেখ করলেই বোঝা যাবে। আমাদের দেশে পঞ্চম শ্রেণিতে শিশুরা পড়ে ৬টি বিষয়। সেই শিশু ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে ১৩টি বিষয়। যারা এসব বিষয় পাঠ্য করে তারা কি কখনও ভাবে যে শিশুটির মেরুদ-ের জোর কতোটা? এক বছরের ব্যবধানে একটি শিশুকে কি কোনভাবে নতুন সাতটি বিষয় পড়তে দেয়া যায়? দুনিয়ার কোন শিক্ষা বিশেষজ্ঞ কি এমন পরামর্শ দিতে পারেন? দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের প-িতগণ সেই কাজটি করেছেন। শুধু কি তাই- পাঠক্রমে যে পরিমাণ বই বা পাঠক্রম আছে বেসরকারি, ইংরেজি মাধ্যম এমনকি মাদ্রাসারও বই বা পাঠক্রম তার চাইতে অনেক বেশি। শিশুশ্রেণির একটি শিশুর যেখানে খেলায় খেলায় পড়ার কথা সেখানে তাকে বই-এর পর বই চাপিয়ে দেয়া হয়। কোন কোন ক্ষেত্রে কেবল মাত্র কমিশন পাবার জন্য বাড়তি বই পাঠ্য করা হয়। শিশুর জন্য এক সাথে বাংলা-ইংরেজি ও আরবী ভাষার অত্যাচারতো আছেই।
আমি মনে করি, স্কুল ব্যাগের ওজন কমানোটা সমাধান নয়। বরং এখন দুনিয়ার সর্বত্র স্কুল ব্যাগ উধাও করার প্রচেষ্টা চলছে। আমরা নিশ্চিত করেই জানি যে, ডেনমার্কের স্কুলে বই দিয়ে লেখাপড়া করানো হয় না। সিঙ্গাপুরের ছেলে মেয়েরা আইপ্যাড দিয়ে পড়াশোনা করে। মালয়েশিয়ার স্মার্টস্কুলগুলোতে কাগজের বই কোন প্রয়োজনীয় অনুসঙ্গই নয়। যুক্তরাজ্যের স্কুলগুলো সম্পর্কে ৪ ডিসেম্বর ২০১৪ তারিখের দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় একটি খবর প্রকাশিত হয়েছে। খবরটির অংশবিশেষ দেখেই বলা যাবে ভারী ওজনের স্কুলব্যাগের উধাও করাটাই সমাধান।
খবরটির শিরোনাম যুক্তরাজ্যের ৭০ শতাংশ বিদ্যালয়ে ট্যাবলেট। খবরটি এরকম: “যুক্তরাজ্যের প্রায় ৭০ শতাংশ প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে ট্যাবলেট কম্পিউটার। বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের নতুন প্রযুক্তির সুবিধা দিতে এবং শিক্ষাক্ষেত্রে প্রযুক্তির সুবিধা নিতে ট্যাবলেট কম্পিউটার ব্যবহার বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে যুক্তরাজ্য। আর সেজন্যই বিদ্যালয়গুলোতে ট্যাবলেট কম্পিউটার দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি এক গবেষণায় এ তথ্য জানা গেছে। গবেষণার অংশ হিসেবে ৬৭১টি বিদ্যালয়ে জরিপ চালানো হয়। বিদ্যালয়গুলোতে ট্যাবলেটের এমন ব্যবহার বাড়ার ফলে প্রযুক্তির প্রতি শিক্ষার্থীদের আগ্রহ যেমন বাড়ছে তেমনি বাসা এবং বিদ্যালয়ে প্রযুক্তির নানা সুবিধাও ব্যবহার করছে শিক্ষার্থীরা। বার্বি ক্লাক অব দ্য ফ্যামিলি, কিডস অ্যান্ড ইয়ুথ রিসার্চ গ্রুপের করা এ গবেষণায় বলা হয়েছে, যুক্তরাজ্যের ৬৮ শতাংশ প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং ৬৯ শতাংশ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ট্যাবলেট কম্পিউটার ব্যবহারের সুযোগ পাচ্ছে। এর মধ্যে প্রায় ৯ শতাংশ বিদ্যালয়ে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জন্য একটি ট্যাবলেট ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। এসব শিক্ষার্থীর মধ্যে বিদ্যালয়ের বাইরে বাসায় প্রায় ৭০ শতাংশ তরুণ শিক্ষার্থী ট্যাবলেট কম্পিউটার ব্যবহার করে। শিক্ষার্থীদের ট্যাবলেট ব্যবহারের এমন হার ইন্টারনেট ব্যবহারের ক্ষেত্রেও বেশ সহায়তা করছে বলে জানিয়েছে গবেষক দল। যে হারে এ সংখ্যা বাড়ছে তাতে ২০১৬ সালের মধ্যে ট্যাবলেট ব্যবহারের সংখ্যা বেড়ে হবে নয় লাখ। চলতি বছরে এ সংখ্যা হলো চার লাখ ৩০ হাজার।…..” যুক্তরাজ্যের শিশুদের এই পরিসংখ্যান বস্তুত একটি ডিজিটাল শিক্ষাব্যবস্থার প্রকৃত দিক নির্দেশনা প্রদান করছে।
আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৪ সালের ১লা জানুয়ারী বলেছিলেন যে, তিনি এদেশের ছাত্র ছাত্রীদেরকে ল্যাপটপ নিয়ে স্কুলে যেতে দেখতে চান। স্বপ্ন দেখার এই মানুষটি ২০০৮ সালে ডিজিটাল বাংলাদেশ ঘোষণা করে বস্তুত দেশটির আগামী দিনের লক্ষ্য নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন।
আমি এটিও স্মরণ করতে পারি যে ২০১৩ সালের ২১ শে মে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ডিজিটাল ক্লাশরুমের উদ্বোধন করেছিলেন। এরপর ডিজিটাল ক্লাশরুম নিয়ে আলোচনা কম হয়নি। কর্মকান্ডও কম হয়নি। ২০১৫ সালের ২ জুন এ টু আই প্রকল্প বর্ষপূর্তি উদয়াপন করবে বলে জানা গেছে।
কিন্তু অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রীর কথা কেউ শোনে না। আমি ভীষণভাবে আনন্দিত হয়েছিলাম যখন শুনেছিলাম যে, আমাদের ক্লাশরুমগুলো মাল্টিমিডিয়া ক্লাশরুম হচ্ছে। সেই কবে থেকে চিৎকার করছি-শিক্ষায় মাল্টিমিডিয়া ব্যবহার করুন। ৯৯ সালের ২৪ ডিসেম্বর গাজীপুরে মাল্টিমিডিয়া স্কুলেরও উদ্বোধন করেছি। সেই কবে থেকে শিক্ষামূলক মাল্টিমিডিয়া কনটেন্ট তৈরি করছি। সেই কবে থেকে মাল্টিমিডিয়া প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। যত দেন দরবার করা দরকার সেইসব করছি। তবুও কাউকেই বোঝাতে পারিনি যে, কাগজ-কলম-চক-ডাস্টারের দিন শেষ। যখন দেখলাম, ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার সরকার একলাফে ২০ হাজার ৫ শত মাল্টিমিডিয়া ক্লাশরুম গড়ে তুলছে তখন আমার আনন্দ আর কে দেখে। কিন্তু প্রথম হোঁচট খেয়েছিলাম যখন দেখেছিলাম যে এই প্রকল্পে বাংলা লেখার কোনো সফটওয়্যারই নেয়া হয়নি। নিজেকে প্রশ্ন করেছিলাম-এর মানে কি যে, এইসব ক্লাশরুমে বাংলা লেখা হবে না? ওরা সবাই কি ইংরেজি মাধ্যমে পড়বে এবং এমনকি বাংলাকে একটি ভাষা হিসেবেও পড়বে না? জবাব পেয়েছিলাম, না বাংলা লেখা হবে-তবে সেটি রোমান হরফ দিয়ে। ইংরেজি হরফ দিয়ে বাংলা লিখে সেটিকে বাংলা বানানো হবে। এরপর আরও জানলাম যে, এই প্রকল্পে যেসব প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে সেগুলোতেও রোমান হরফেই বাংলা লেখা শেখানো হয়েছে। বোঝেছিলাম যে, বরকত-সালাম-রফিক-জব্বারের যোগ্য উত্তরসূরীরাই এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এরপর আর তেমন কোন কথা বলিনি। সেদিন হঠাৎ করে দেখি একটি পত্রিকায় সেই মাল্টিমিডিয়া ক্লাশরুম খবর হয়েছে। তেমন খবর না পড়ে কি পারা যায়!
দৈনিক আমাদের সময়-এর ১৮ অক্টোবর ২০১৪ সংখ্যায় ৩-এর পাতায় এম এইচ রবিন-এর লেখা “মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম কার্যকরের বিশেষ উদ্যোগ” শিরোনামে একটি ছোট খবর ছাপা হয়েছে। খবরটি বাংলাদেশের ডিজিটাল রূপান্তর নিয়ে যাদের আগ্রহ আছে তাদের নজরে পড়ার কথা। খবরটি এরকম, “সারা দেশে স্কুল-কলেজ ও মাদ্রাসায় মালটিমিডিয়া শ্রেণিকক্ষের কার্যক্রম বাস্তবায়নে বিশেষ উদ্যোগ হাতে নিয়েছে সরকার। ২০ হাজার ৫শ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ডিজিটাল কাসরুম এবং ডিজিটাল কনটেন্টের মাধ্যমে পাঠদান কার্যক্রম নিশ্চিত করতে মাস্টার ট্রেইনারের দায়িত্ব পালন করবে সাড়ে ৪ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
আইসিটি প্রকল্পের তথ্যানুযায়ী, প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত সাড়ে ৪ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ‘লিডারশিপ’ হিসেবে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব পালন করবে। এসব প্রতিষ্ঠানকে মহানগর, বিভাগ, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে ভাগ করা হয়েছে। ঢাকা মহানগরের বেসরকারি ৮০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৬০টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ১৫টি কলেজ এবং ৫টি মাদ্রাসা রয়েছে। ঢাকা মহানগরের সব সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও মাদ্রাসা এর আওতায় আসবে।
জানা গেছে, মালটিমিডিয়া কার্যক্রমের সফল বাস্তবায়নে যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তাতে সরকারি কলেজগুলোকে আলাদা করে মনিটরিং করা হবে। এ বিষয়ে যথাযথ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একসেস টু ইনফরমেশন প্রোগ্রাম (এটুআই) চিঠি দিয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরকে।
এটুআই প্রকল্পের ই-লার্নিং স্পেশালিস্ট প্রফেসর ফারুক আহমেদ স্বাক্ষরিত পাঠানো ওই চিঠিতে বলা হয়, মালটিমিডিয়া শ্রেণিকক্ষ ও শিক্ষকদের তৈরি ডিজিটাল কনটেন্ট কার্যক্রম যথাযথভাবে চালু নেই এবং বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের পঠন-পাঠন কার্যক্রমের গুণগতমান নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। সঠিক তদারকির অভাবে এ প্রকল্প নিষ্ফলা। তাই বাছাইকৃত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাস্টার ট্রেইনারদের দিয়ে এখন ডিজিটাল কনটেন্ট তৈরি ও পাঠদান কার্যক্রম শতভাগ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক আবুল কালাম আজাদ আমাদের সময়কে জানান, আশা করছি, এ ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণে মালটিমিডিয়া শ্রেণিকক্ষের যথাযথ সুফল শিক্ষার্থীদের দোরগোড়ায় পৌঁছে যাবে। আর এই সাড়ে ৪ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এখন অন্য সব প্রতিষ্ঠানের ‘লিডারশিপ’ হিসেবে কাজ করবে। নির্বাচিত এসব প্রতিষ্ঠানের গভর্নিং বডির সদস্য, বিদ্যালয় প্রধানসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে ট্রেনিং, মডারেশনসহ বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দিয়ে তৈরি করা হবে। তারা লব্ধ অভিজ্ঞতা পার্শ্ববর্তী অন্যান্য সব প্রতিষ্ঠানে প্রয়োগ করবে।
সূত্র জানায়, আইসিটি প্রকল্পের অধীনে দেশের ২০ হাজার ৫শ স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায় একটি করে ডিজিটাল শ্রেণিকক্ষ স্থাপন করা হয়েছে। এসব বিদ্যালয়ে সরবরাহ করা হয়েছে একটি করে ল্যাপটপ, স্পিকার, ইন্টারনেট মডেম, মালটিমিডিয়া প্রজেক্টর ও স্ক্রিন। একজন শিক্ষককে ১২ দিনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৩০৫ কোটি ৬৫ লাখ ৩৪ হাজার টাকা। আর শিক্ষক প্রশিক্ষণসহ প্রতিটি ডিজিটাল শ্রেণিকক্ষ স্থাপন করতে সরকারের ব্যয় হয়েছে ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা। যদিও প্রায় পৌনে ৪ বছরে প্রকল্পের ৩০৫ কোটি ৬৫ লাখ ৩৪ হাজার টাকার মধ্যে ব্যয় হয়েছে ২৫৬ কোটি টাকা।”
খবরটিতে প্রায় সকল কথাই বলা আছে। শুধু বলা নেই, এই প্রকল্পটি কবে বাস্তবায়ন শুরু হয়, টাকা কে দিয়েছে এবং প্রকল্পটির বাকি টাকা কবে কিভাবে ব্যয় করা হবে। এসব তথ্য সাথে থাকলে যে কারও পক্ষে বিষয়টি সম্পর্কে আরও স্পষ্ট ধারনা পাওয়া সহজ হতো। অবশ্য আমি এসব সেভাবে খুজতেও চাইনা। আমি এ্ই প্রকল্প সম্পর্কে যেটুকু জানি তার সূত্র ধরেই এর অপূর্ণতাটুকু কেমন করে পূরণ করা যায় সেটি নিয়ে আলোচনা করতে চাই।
খবরে এটুআই-এর বিশেষজ্ঞ ফারুক সাহেবের লেখা চিঠিতে বলা হয়েছে, “মাল্টিমিডিয়া শ্রেণিকক্ষ ও শিক্ষকদের তৈরি ডিজিটাল কনটেন্ট কার্যক্রম যথাযথভাবে চালু নেই এবং বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের পঠন-পাঠন কার্যক্রমের গুণগতমান নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। সঠিক তদারকির অভাবে এ প্রকল্প নিষ্ফলা।” ফারুক সাহেবরাই এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছেন। এই প্রকল্পের দুটি বড় কম্পোনেন্ট ছিলো ক) হার্ডওয়্যার সংগ্রহ এবং খ) প্রশিক্ষণ প্রদান। দুটি কাজই তারা দক্ষতার সাথেই করেছেন। তবে যেসব হার্ডওয়্যার সরবরাহ করা হয়েছিলো তার বেশির ভাগেরই এখন ব্যবহার নেই। এমন অভিযোগ আছে যে, প্রতিষ্ঠানপ্রধান বা ব্যবস্থাপনা কমিটির প্রভাবশালীরা এসব দ্রব্য নিজের বাড়িতেও নিয়ে গেছ্।ে সমস্যাটি আসলে অন্যত্র। একবাক্যে বলতে হলে বলতে হবে এখানে ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দেয়া হয়েছে। কোনো ধরনের কনটেন্ট ছাড়া হার্ডওয়্যার আর প্রশিক্ষণ দিয়ে আর যাই হোক মাল্টিমিডিয়া ক্লাশরুম হয় না। কেবলমাত্র পাওয়ার পয়েন্ট ব্যবহার করতে শিখে প্রশিক্ষণপ্রাপ্তরা যেসব কনটেন্ট বানাতে পেরেছে তাতে শিক্ষার ডিজিটাল রূপান্তর হতে পারেনা। প্রকল্প তৈরির সময় কনটেন্ট তৈরির বিষয়টি কেন ভাবাই হয়নি সেটি আমি এখনও বুঝতে পারিনা।
অন্যদিকে পত্রে মনিটরিং করার যে বিষয়টির কথা উল্লেখ করা হয়েছে, সেটিতো এটুআই-এরই করার কথা। এটুআইকেই এখন নির্ধারণ করতে হবে, মনিটরিং কে করবে বা কিভাবে করবে। মাউশি বা এটুআই কারও পক্ষেই যে কাজটি করা হয়নি, সেটি স্বীকার করে এই প্রকল্প থেকেই একটি মনিটরিং পদ্ধতি খুজে বের করে নেয়া ভালো। তবে বিশেষজ্ঞ মহোদয় যে নিষ্ফলা মন্তব্য করেছেন তার মূল কারণ প্রকল্পের ত্রুটি। প্রকল্পের তৃতীয় একটি কম্পোনেন্ট যদি থাকতো তবে এটি নিষ্ফলা প্রকল্প হতো না।
খবর অনুসারে প্রকল্পের ৪৯ কোটি টাকা এখনও ব্যয় করা হয়নি। শুধুমাত্র প্রকল্পটিকে একটি রিভাইজ করে এতে পাঠ্যপুস্তকের মাল্টিমিডিয়া কনটেন্ট পেশাগতভাবে তৈরি করার কাজটা করলেই অসম্পূর্ণ প্রকল্প পুরোই সফল হয়ে যাবে। বিশেষজ্ঞরা এটি কেন বোঝেন না যে, শিক্ষকরা তাদের প্রয়োজনে ছোট খাটো কনটেন্ট তৈরি করতে পারলেও পেশাদারি কনটেন্ট তৈরি করতে পারেন না। যেমন করে সরকারকে পাঠ্য বই ও পাঠক্রম তৈরি করে দিতে হয়, তেমনি করে ক্লাশরুমের পাঠ্যবইকেন্দ্রিক কনটেন্ট সরকারকেই করে দিতে হবে। এজন্য পেশাদার আঁকিয়ে, পেশাদার শব্দ কারিগর, পেশাদার প্রেগ্রামার এবং কনটেন্ট নির্মাতার প্রয়োজন হবে। আমি এটি আশা করতে পারি না যে, একটি পাঠ্যবই একজন শিক্ষক তৈরি করে দেবেন। সেটি সম্ভব হলে এনসিটিবির দরকার হতো না। সেই কারণেই ডিজিটাল কনটেন্ট তাদেরকে দিয়েই করতে হবে যারা এর দক্ষতা রাখেন।
আমি জানি না এটুআই-এর নীতি ও কর্মপন্থায় কোন পরিবর্তন আসবে কিনা। তবে যদি পরিবর্তন না আসে তবে বুঝতে হবে প্রকল্পটি ব্যর্থ করার জন্যই হয়তো একে অসম্পূর্ণ করে রাখা হয়েছে।
আমাদের মতো গরীব দেশে একটি প্রকল্প তৈরি করা, সেটির জন্য অর্থ যোগাড় করা ও সেটি বাস্তবায়ন করা খুবই দুরূহ কাজ। তাই আমাদের প্রত্যাশা থাকে এই গরীব দেশের টাকা যেন যথাযথভাবে ব্যবহৃত হয় এবং কোন প্রকল্প যেন ব্যর্থ না হয়। আমি নিজে শিক্ষার মাল্টিমিডিয়া বা ডিজিটাল রূপান্তরের স্বপ্ন দেখি এবং সেই স্বপ্ন নিয়ে কাজ করি। আমি এরই্ মাঝে বিজয় শিশু শিক্ষা এবং বিজয় প্রাথমিক শিক্ষা নামের পেশাদারী উপাত্ত বা শিক্ষামূলক সফটওয়্যার তৈরি করেছি। কিন্তু আমারতো কোটি কোটি টাকা নেই যে, আমি সকল শ্রেণির সকল পাঠ্য বইকে ইন্টারএ্যাকটিভ মাল্টিমিডিয়া সফটওয়্যারে রূপান্তর করতে পারবো। বরং কোটি টাকায় সফটওয়্যার বানিয়ে যখন সেটি ২০০ টাকায় বেচতে হয় এবং যখন সেটিও পাইরেসির শিকার হয় তখন আর সামনে যাওয়া যায় না। অনুরোধ করবো, তারা যেন এই দৃষ্টান্তগুলো পর্যবেক্ষণ করে সামনের পথে পা বাড়ান। তাঁদেরকে নতুন করে চাকা আবিষ্কার করতে হবে না, আমরা ডিজিটাল কনটেন্ট বিষয়ক চাকা আবিষ্কার করেই রেখেছি। তারা যদি সেই চাকাটিকে সামনে নেবার ব্যবস্থা করেন তবেই সহসাই আমরা শিশুদেরকে মেরুদ- সোজা করে হাঁটাতে পারি। সম্ভবত তখন আমরা বলতে পারবো যে স্কুল ব্যাগ নয়, ল্যাপটপ বা ল্যাপটপেই পড়বে আমাদের সন্তানেরা। আমাদের কা¬শরুমগুলোও তখন মালয়েশয়া, সিঙ্গাপুর, ডেনমার্ক বা যুক্তরাজ্যের মতো হয়ে উঠবে। আমি এটিও প্রত্যাশা করি যে, হাঁটুভাঙ্গা ধরনের ডিজিটাল ক্লাশরুম আমাদের দৃষ্টান্ত হয়ে উঠবে না। সুখের বিষয় আমরা স্কুলব্যাগটা যে উধাও করতে পারি তার দৃষ্টান্ত বাংলাদেশেই স্থাপন করেছি। আমাদের মাল্টিমিডিয়া বা ডিজিটাল স্কুলগুলো সেই দৃষ্টান্তই প্রদর্শন করছে। একদিন দেশের সকল ক্লাশরুমই এমন ডিজিটাল হবে।
ঢাকা, ৩১ মে ২০১৫ ॥ লেখক তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান- সাংবাদিক, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যার এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ-এর প্রণেতা ॥ ই-মেইল ঃ mustafajabbar@gmail.com, ওয়েবপেজ: www.bijoyekushe.net