বাংলাদেশের সেমিকন্ডাক্টর অগ্রযাত্রায় নেতৃত্ব দিচ্ছে উলকাসেমি

মোহাম্মদ কাওছার উদ্দীন

বিশ্ব প্রযুক্তি মানচিত্রে বাংলাদেশের নিজস্ব পরিচয় তৈরি করতে এক নতুন সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র হিসেবে উঠে এসেছে দেশের সেমিকন্ডাক্টর শিল্প। এ খাতের অগ্রযাত্রায় নেতৃত্ব দিচ্ছে বাংলাদেশী সেমিকন্ডাক্টর প্রতিষ্ঠান উলকাসেমি, যারা ২০০৭ সাল থেকে দেশে সেমিকন্ডাক্টর ডিজাইন করে আসছে; পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকন ভ্যালি, কানাডা ও ভারতে বৈশ্বিক কার্যক্রম পরিচালনা করছে।

দক্ষ জনবল গড়ে তোলা, শিল্প সম্প্রসারণে অগ্রণী ভূমিকা রাখা এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে উলকাসেমি বাংলাদেশকে বৈশ্বিক সেমিকন্ডাক্টর শিল্পের একটি গুরুত্বপূর্ণ বাজার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

আমরা উলকাসেমির অগ্রযাত্রা, বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান সেমিকন্ডাক্টর ইকোসিস্টেম এবং আগামীর সম্ভাবনা জানতে উলকাসেমির সিইও ও প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ এনায়েতুর রহমানের সঙ্গে আলাপ করেছি।

 

প্রশ্ন : উলকাসেমি ২০০৭ সালে বাংলাদেশে যাত্রা শুরু করে। সেই সময় বাংলাদেশে একটি সেমিকন্ডাক্টর ডিজাইন কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করতে আপনি কিভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছেন?

উত্তর: আমরা ২০০৭ সালে উলকাসেমি প্রতিষ্ঠা করি, তখন বাংলাদেশে সেমিকন্ডাক্টর শিল্প বলতে কিছুই ছিল না। অনেকেই মনে করতেন, এখানে কিছু করা সম্ভব নয়। কিন্তু সিলিকন ভ্যালিতে কাজের অভিজ্ঞতায় আমি দেখেছি, এই শিল্প দ্রুত বিকশিত হচ্ছে এবং ৯০ এর দশকের পর থেকে এশিয়ার দিকে তা আসছে। তখনই মনে হয়েছিল, বাংলাদেশও একদিন এর অংশ হতে পারে।

দেশের মেধাবী তরুণদের প্রশিক্ষণ দিয়ে আন্তর্জাতিক প্রকল্পে কাজ করানো সম্ভব- এই বিশ্বাসে যুক্তরাষ্ট্রের স্থায়ী জীবন ছেড়ে দেশে ফিরে মাত্র চারজন প্রকৌশলী নিয়ে কাজ শুরু করি। শুরুতে দক্ষ জনবল, অবকাঠামো ও বাজারের সীমাবদ্ধতা ছিল, তবে লে-আউট ডিজাইন দিয়ে আমরা কাজ শুরু করি। ধীরে ধীরে দল ও কাজের পরিধি বড় হলো, এখন আর্কিটেকচার থেকে ব্যাকএন্ড পর্যন্ত পুরো প্রক্রিয়ায় কাজ করি।

উলকাসেমির এই পথচলা প্রমাণ করেছে, বাংলাদেশও সেমিকন্ডাক্টর শিল্পে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

 

প্রশ্ন : উলকাসেমির সাফল্যের পেছনে কোন কোন গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক পদক্ষেপগুলো ভূমিকা রেখেছে?

উত্তর: উলকাসেমির প্রথম বড় মাইলফলক ছিল প্রতিষ্ঠার মাত্র দুই প্রান্তিকের মধ্যে কোনো ঋণ ছাড়া সম্পূর্ণ আয়ের ওপর নির্ভর করে লাভজনক হওয়া। অর্জিত আয় পুনঃবিনিয়োগ করে আমরা টেকসই প্রবৃদ্ধির ভিত্তি তৈরি করেছি।

দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে সংযোগ তৈরি, যা দক্ষ জনবল তৈরির পথ খুলে দিয়েছে। পাশাপাশি, সিলিকন ভ্যালি, কানাডা ও ভারতে অফিস স্থাপন করে বৈশ্বিক অভিজ্ঞতা কাজে লাগানো হয়েছে।

আমাদের নীতি ছিল ‘ব্যর্থতা কোনো বিকল্প নয়’। প্রতিটি প্রকল্প বিশ্লেষণ, সঠিক জনবল নির্ধারণ ও সময়মতো সম্পন্ন করার ধারাবাহিকতা উলকাসেমিকে আন্তর্জাতিক স্তরে আস্থা ও সাফল্যের প্রতীক করেছে।

 

প্রশ্ন :  স্থানীয় প্রকৌশলীদের প্রশিক্ষণ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে সহযোগিতার ক্ষেত্রে আপনাদের উদ্যোগগুলো কি কি?

উত্তর: উলকাসেমি শুরু থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতায় কাজ করছে। আমরা চেষ্টা করেছি পাঠ্যক্রমকে শিল্পের চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করা, নতুন প্রাসঙ্গিক কোর্স চালু করা এবং শিক্ষক প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করার মতো বিষয়গুলোকে অগ্রাধিকার দিতে। শুরুতে শুধুমাত্র বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) ইলেকট্রনিক ডিজাইন অটোমেশন (ইডিএ) টুল ছিল, কিন্তু এখন প্রায় ২০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে এসব টুল ব্যবহার হচ্ছে, যা স্থানীয় সক্ষমতা বৃদ্ধি করছে।

আমরা প্রথমে চারজন ইঞ্জিনিয়ার নিয়ে ইন-হাউস প্রশিক্ষণ শুরু করি, আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের সহায়তায় তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি করি এবং পরে তারা নতুন ইঞ্জিনিয়ারদের প্রশিক্ষণ দেয়। বিশ্ববিদ্যালয় ও শিল্পের সহযোগিতা এবং আমাদের নিজস্ব প্রশিক্ষণ কাঠামোর সমন্বয়ে দক্ষ প্রকৌশলীদের একটি শক্তিশালী ভিত্তি তৈরি হয়েছে।

 

প্রশ্ন :  উলকাসেমির পাশাপাশি এখন বাংলাদেশে আরও কিছু সেমিকন্ডাক্টর কোম্পানি গড়ে উঠছে। আপনি এই ক্রমবর্ধমান ইকোসিস্টেমকে কীভাবে দেখছেন?

উত্তর: বাংলাদেশের সেমিকন্ডাক্টর ইকোসিস্টেম এখনও বিকাশের প্রাথমিক ধাপে, যেখানে উলকাসেমির পাশাপাশি কিছু নতুন প্রতিষ্ঠানও কার্যক্রম শুরু করেছে। জ্ঞানভিত্তিক এই শিল্পে প্রথম উদ্যোগ গ্রহণকারীরাই নেতৃত্ব দেয়, কারণ আন্তর্জাতিক ক্লায়েন্টরা প্রমাণিত অভিজ্ঞতা ও দক্ষতার ওপর ভিত্তি করে অংশীদার নির্বাচন করে। আমরা ইতিমধ্যে বৈশ্বিক ক্লায়েন্টদের সঙ্গে কাজের মাধ্যমে সেই সক্ষমতা প্রমাণ করেছি।

নতুন কোম্পানিগুলোর জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো দক্ষ জনবল তৈরি। তবে প্রতিযোগিতা ইতিবাচক, এটি উদ্ভাবন ত্বরান্বিত করে। সঠিক অবকাঠামো, প্রশিক্ষণ ও ক্লায়েন্টের আস্থা থাকলে বাংলাদেশও বৈশ্বিক সেমিকন্ডাক্টর শিল্পে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে।

 

প্রশ্ন : যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ভারত ও বাংলাদেশে কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে উলকাসেমি কীভাবে বৈশ্বিক সহযোগিতা ও স্থানীয় সক্ষমতা বৃদ্ধির মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখে?

উত্তর: প্রতিটি প্রকল্পের জন্য সঠিক দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার সমন্বয় জরুরি। জটিল প্রকল্পে স্থানীয় জনবল যথেষ্ট না হলে আমাদের যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও ভারতের অফিসগুলো আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা প্রদান করে। বাংলাদেশি তরুণ প্রকৌশলীরা অভিজ্ঞ ইঞ্জিনিয়ারদের সঙ্গে কাজ করে বাস্তব প্রকল্পের হাতে কলমে অভিজ্ঞতা অর্জন করে এবং ধীরে ধীরে জটিল দায়িত্ব নিতে সক্ষম হয়।

প্রয়োজনে আমরা আন্তর্জাতিক রোটেশনও করি, যেমন বাংলাদেশি ইঞ্জিনিয়ারদের বিদেশে পাঠিয়ে ক্লায়েন্টের চাহিদা পূরণ করা। এই বৈশ্বিক-স্থানীয় ভারসাম্য আমাদের প্রকল্প সফল করতে এবং বাংলাদেশে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে সহায়তা করে, একই সঙ্গে উলকাসেমির বৈশ্বিক সক্ষমতাও শক্তিশালী করে।

 

প্রশ্ন : উলকাসেমির পরবর্তী পরিকল্পনা কী?

উত্তর: উলকাসেমির পরবর্তী বড় পদক্ষেপ হলো জার্মানির মিউনিখে একটি নতুন অফিস খোলা, যা ইউরোপের আঞ্চলিক ডিজাইন ইকোসিস্টেমে অংশ নেওয়ার সুযোগ দেবে। এটি অটোমোটিভ ও বিশেষায়িত প্রযুক্তি খাতে দক্ষতা ও আন্তর্জাতিক সমন্বয় শক্তিশালী করবে এবং আইপি উন্নয়ন ও বৈশ্বিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করবে।

আমরা জাপানেও সম্ভাবনা অনুসন্ধান করছি, যেখানে উন্নত ম্যানুফ্যাকচারিং ও টেস্টিং প্রযুক্তিতে প্রবেশের সুযোগ রয়েছে। যদিও দক্ষ জনবল এখনো বড় চ্যালেঞ্জ, বিদেশে অফিস সম্প্রসারণ বাংলাদেশি প্রকৌশলীদের জন্য আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা ও দেশে দক্ষতা উন্নয়নের সুযোগ তৈরি করবে। আমাদের লক্ষ্য হলো বৈশ্বিক প্রতিভা একত্রিত করা, বাংলাদেশি প্রকৌশলীদের জন্য অর্থবহ সুযোগ তৈরি করা এবং উলকাসেমিকে আন্তর্জাতিক সেমিকন্ডাক্টর শিল্পে একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা।

 

প্রশ্ন : বাংলাদেশে টেকসই সেমিকন্ডাক্টর ইকোসিস্টেম গড়ে তুলতে কী ধরনের চ্যালেঞ্জ রয়েছে?

উত্তর: বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো শিল্প সম্পর্কে সচেতনতার অভাব এবং সঠিক দক্ষ জনবল তৈরি না হওয়া। বৈশ্বিক চাহিদা থাকা সত্ত্বেও এ বিষয়ে অভিজ্ঞ পেশাজীবী কম, যারা আছেন তাদের অনেকেই আবার বিদেশে চলে যাচ্ছে, যা দেশকে সেমিকন্ডাক্টর বাজারে সুযোগ গ্রহণে সীমিত করছে।

আরেকটি সমস্যা হলো শিক্ষার্থীদের জন্য সঠিক ক্যারিয়ার গাইডেন্সের অভাব। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষ থেকেই শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যুক্ত থেকে তাদের ক্যারিয়ার পরিকল্পনা এবং শিল্পের চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ দক্ষতা অর্জনে সহায়তা করি।

যদি শিক্ষা ব্যবস্থা সংস্কার করা যায়, ধারাবাহিক শেখার ও কঠোর পরিশ্রমের সংস্কৃতি গড়ে তোলা যায় এবং দক্ষ জনবল তৈরি হয়, তাহলে বাংলাদেশে একটি টেকসই সেমিকন্ডাক্টর ইকোসিস্টেম গড়ে তোলা সহজ হবে।

 

প্রশ্ন : সম্প্রতি বাংলাদেশ সেমিকন্ডাক্টর ইন্ডাস্ট্রি অ্যাসোসিয়েশন (বিএসআইএ) গঠিত হয়েছে। উলকাসেমি ও বিএসআইএ-এর সহযোগিতা আপনি কীভাবে দেখছেন এবং সরকার কিভাবে এই খাতকে সহায়তা করতে পারে?

উত্তর: উলকাসেমি বিএসআইএ-এর সক্রিয় সদস্য এবং অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে বিভিন্ন উদ্যোগে অংশগ্রহণ করে। আমরা মনে করি, সরকারের অগ্রাধিকার হওয়া উচিত এমন প্রণোদনা যা দক্ষতা উন্নয়ন ও অবকাঠামো সমর্থন করে- যেমন প্রশিক্ষণ তহবিল, বিশ্ববিদ্যালয়ে সেমিকন্ডাক্টর টুল সরবরাহ এবং লক্ষ্যভিত্তিক নগদ প্রণোদনা দিয়ে শিল্পের প্রবৃদ্ধি উৎসাহিত করা।

বিএসআইএ ইতিমধ্যে আইসিটি মন্ত্রণালয় সহ অন্যান্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কাজ করে দেশের সেমিকন্ডাক্টর ইকোসিস্টেমকে শক্তিশালী করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।

 

প্রশ্ন : বাংলাদেশকে কীভাবে বৈশ্বিক সেমিকন্ডাক্টর সাপ্লাই চেইনের একটি অর্থবহ অংশীদার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা যায় বলে আপনি মনে করেন?

উত্তর: বাংলাদেশের বৈশ্বিক সেমিকন্ডাক্টর সাপ্লাই চেইনে অর্থবহ অবদান রাখার সম্ভাবনা রয়েছে, বিশেষ করে উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে। চিপ উৎপাদন শুধু বাণিজ্যিক নয়, জাতীয় নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ।

প্রাথমিক উৎপাদন এবং যৌথ উদ্যোগ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি হবে এবং বিনিয়োগ আকর্ষণ সম্ভব। মালয়েশিয়ার মতো হাব হিসেবে বাংলাদেশকে প্রতিষ্ঠিত করতে, প্রশিক্ষিত মানবসম্পদ, অবকাঠামো ও উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধি অপরিহার্য।

প্রশ্ন : উলকাসেমির দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য কী?

উত্তর: উলকাসেমির দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য হলো হাজার হাজার প্রকৌশলীর একটি বৈশ্বিক দল গড়ে তোলা এবং আগামী দশকে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সেমিকন্ডাক্টর কোম্পানি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়া। বিভিন্ন দেশে আমাদের অফিস থাকার কারণে আমরা বৈশ্বিক ইকোসিস্টেমের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হতে পারি এবং ইতিমধ্যেই তাইওয়ানসহ বিভিন্ন প্রযুক্তি হাবে আমরা পরিচিত।

বর্তমানে উলকাসেমিতে ৫৭০-এর বেশি প্রকৌশলী কাজ করছে, যা অন্যদেরও এই খাতে আগ্রহী হওয়ার জন্য উৎসাহিত করবে।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।